মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল, ২০১৪

'দ্যা সেন্স অফ অ্যান এন্ডিং' (৪)


মূলঃ
জুলিয়ান বার্নস
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা

হেডমাস্টার মশাই যে গুরুগম্ভীর স্বরে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা কিংবা কোন স্পোর্টে হেরে যাওয়ার চরম দুঃসংবাদ ঘোষণা করেন, সেই একই স্বরে আসেম্‌ব্লিতে এসে একদিন সকালে বললেন যে উনি এক ভয়ংকর রকম দুঃসংবাদ বয়ে এনেছেন। উইকএন্ডে সাইন্স সিক্সথ্‌-এর রবসন মারা গেছে। ভয়ে আমরা বিড়বিড় করতে থাকলাম। আর তার মধ্যে উনি আরো বললেন যে রবসন তারুণ্যের ফুল হয়ে ফুটে উঠবার আগেই ঝরে গেল। রবসনের মৃত্যু পুরো স্কুলের জন্যই এক সমূহ ক্ষতি। এবং আমরা সবাই ওর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় প্রতীক হিসাবে হলেও উপস্থিত থাকব। উনি সবকিছুই বললেন। শুধু বললেন না যা আমরা আসলে জানতে চাই। কিভাবে...কেন...আর যদি সত্যিই এটা খুন হয়ে থাকে, তবে কে তা করল।
দিনের প্রথম ক্লাশের আগে এডরিয়্যান মন্তব্য রে উঠল, “ইরোস আর থানাটোস” - “যৌন-ক্ষুধা আর মৃত্যু আবারও মৃত্যুর জয় হল।
রবসন ঠিক ‘ইরোস আর থানাটোস’ মেটেরিয়াল ছিল না।” এ্যালেক্স তাকে জানাল। কলিন আর আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। আমরা হাড়ে হাড়ে এটা জানতাম কেননা রবসন কয়েক বছর আমাদের ক্লাশেই ছিল। কল্পনা শক্তিহীন, অস্বাভাবিক রকম শিল্পকলায় আগ্রহহীন এক অতি সাধারণ তরুণ। যে কিনা কাউকে কোনদিন অসন্তুষ্ট না করে গড়িয়ে গড়িয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন সে আগে আগে মারা গিয়ে যেন নিজের জন্য একটা নাম কিনে ফেলল। আর তার ফলে আমাদের অসন্তুষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারুণ্যের ফুল বটে! যতসব বস্তা পচা কথা। যে রবসন-কে আমরা চিনতাম সে ছিল এক পুরোপুরি ভেজিটেবল মেটেরিয়াল।
কোন অসুখ বিশুখের কথা কেউ বলল না। সাইকেল-এ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা কিংবা কোথাও কোন গ্যাস বিস্ফোরণের কথা উঠল না। কিছুদিন পর গুজব থেকে(অন্যভাবে বলতে গেলে গণিতের ষষ্ট ক্লাশের ব্রাউ্নের কাছ থেকে) যা জানা গেল তা কর্তৃপক্ষ কোনদিন আমাদের জানাতে পারত না কিংবা জানাতে চাইত না। রবসন তার বান্ধবীকে গর্ভবতী ক’রে তুলেছিল, চিলেকোঠা থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, দুই দিন ধরে কেউ তার খোঁজ পায় নি।
“আমি কোনদিন ভাবিনি যে কিভাবে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে হ’য়, রবসন তা জানত।”
“আরে ও তো সাইন্স সিক্সথ্‌-এ ছিল।”
“তাতেই বা কি। গলায় দড়ি দেওয়ার জন্য বিশেষ ধরণের স্লিপ নটের দরকার হ’য়।”
“সেটা শুধু সিনেমাতে। আর সত্যিকারের মৃত্যুদন্ডে। এলেবেলে নট দিয়েও মরে যাওয়া যায়। শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ হ’তে একটু বেশি সময় লাগবে, এই যা।”
“তা ওর প্রেমিকা কেমন ছিল ব’লে আমাদের মনে হ’য়?”
আমরা আমাদের জানা পথগুলোর কথাই ভাবলাম। পরিপাটি সচ্চরিত্রের  কুমারী(অবশ্য এখন আর কুমারী নয়), সস্তা জমকালো পোষাক প’রা শপগার্ল, অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোন বয়স্ক মহিলা, যৌন অসুখে আক্রান্ত বেশ্যা। আমরা এইসব নিয়ে আলোচনা চালিয়েই যেতে থাকলাম যতক্ষণ না এডরিয়্যান আমাদের উত্‌সাহ-কে অন্য পথে নিয়ে গেল।
“কামু বলেছেন আত্মহত্যা-ই একমাত্র দার্শনিক প্রশ্ন।”
“ন্যায় অন্যায়, রাজনীতি, শিল্প, বাস্তব এবং অন্য আর সবকিছুর প্রেক্ষাপটটুকু বাদ দিলে।” এলেক্স-এর গলার স্বরে তীক্ষ্‌ণ উত্তেজনা ফুটে উঠল।
“একমাত্র সত্য এটাই। এই সে সারকথা যার উপর অন্য আর সবকিছু নির্ভর করছে।”
রবসনের আত্মহত্যার দীর্ঘ বিশ্লেষণের পর আমরা এই সিদ্ধান্তে আসলাম যে এ ঘটনাকে দার্শনিকভাবে একমাত্র এক গাণিতিক সজ্ঞা দিয়েই মেনে নেওয়া যেতে পারে। জনবিস্ফোরণে আরো একজন হিসাবে যোগ না দিয়ে রবসন মনে করল যে তার নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে এই গ্রহের মানুষের সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা। কিন্তু আর সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে, গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে শেষ পর্যন্ত রবসন আমাদের খাটোই করে গেছে। ওর কাজ কর্ম অদার্শনিক, অসংযমী, স্বার্থপর, কুরুচিপূর্ণ। এক কথায় অন্যায়। আর ওর আত্মহত্যার নোটেও লেখা ছিল,(আবারো ব্রাউনের গুজব থেকেই এটা জানা গেল) ‘মা, আমি দুঃখিত।’ আমাদের মনে হ’ল জনসমাজকে শিক্ষা দেওয়ার এক চরম সুযোগ থেকে যেন এই নোট পুরোপুরি বঞ্চিত ক’রল।

হয়ত আমরা সবাই রবসনের উপর অমন অতিমাত্রায় কঠোর হতাম না যদি না সে একটা প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ, অনড় ঘটনা ঘটিয়ে না ফেলত। রবসন আমাদের বয়সী ছিল। এবং আমাদের ধারণা অনুযায়ী সে ছিল বড় বেশি সাধারণ একেবারেই এক এলেবেলে ছেলে। তবু সে শুধু এক প্রেমিকাই যোগাড় করে নি, তার সাথে সেক্স পর্যন্ত ক’রে ফেলেছে। ফাকিং বাস্টার্ড! কেন সে, আমরা কেন নই? কেন আমাদের মধ্যে কেউ একজন একটা প্রেমিকাও যোগাড় করতে পারল না? সে অবমাননাটুকু আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারে অনন্তঃপক্ষে কিছু একটা যোগ করত – যা কিনা পাপে ভরা, নেতিবাচক কিছু নিয়ে বড় বেশি গর্ব করবার মত(“সত্যি কথা বলতে কি, পুঁজে ভরা হাদা গঙ্গারামের চেয়ে কাপড়ের জুতার যে মহিমা তাতেই উজ্জ্বল জীবন - এই ছিল তার হুবুহু কথা”)। আমরা আমাদের পড়া সব বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম থেকে এমনটা জেনেছিলাম যে প্রেমের ভিতর লুকিয়ে আছে যন্ত্রণা, দুঃখবেদনা। আমরা খুশীমনেই না হ’য় ওই যন্ত্রণাভোগের কিছুটা অভ্যাস করে নিতে পারতাম যদি না ওই কষ্টের ভিতর লুকিয়ে থাকত, কোন না কোনভাবে এমন কোন যুক্তি যা থেকে মনে হতে পারে যে আমাদের জীবনেও প্রেমের কোন রকম সম্ভাবনা আছে।  
অন্যান্য শঙ্কার মধ্যে এটা আমাদের জীবনের আর একটা প্রধান ভয়ের কারণ ছিল। জীবন বুঝি ঠিক সাহিত্যের মত হ’য়ে উঠবে না। আমাদের বাবা-মার দিকে তাকিয়ে দেখ – ওরা কেউ কি কোন রকম সাহিত্যের উপাদান? খুব বেশি হ’লে ওঁরা চেষ্টা চরিত্র ক’রে হয়ত বা দর্শকের খাতায় নাম লেখাতে পারবে। কিংবা মেরে কেটে কোন পার্শ্বচরিত্রে। সামাজিক এক পটভূমির অংশ হিসাবে যেখানে বাস্তব, সত্য, গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু ঘটতে থাকবে। কিসের মত? কেন সেই যে...সাহিত্যের সবকিছু ঘিরেই তো প্রেম, যৌনতা, নৈতিকতা, বন্ধুত্ব, সুখ-শান্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, ব্যাভিচার, ভালো আর খারাপ, নায়ক এবং পাপিষ্ঠ, অপরাধবোধ আর নিরপরাধতা, উচ্চাকাংখা, ক্ষমতা, ন্যায়পরায়ণতা, বিদ্রোহ, যুদ্ধ বিগ্রহ, পিতা এবং পুত্র, মাতা এবং কন্যা, সমাজের বিপক্ষে একজন ব্যাক্তি, সফলতা এবং বিফলতা, খুনাখুনি, আত্মহত্যা, মৃত্যু, ঈশ্বর। আর গোলাঘরের প্যাঁচা। অবশ্যই নানারকমের আর অন্যান্য সাহিত্য আছে। তাত্বিক সাহিত্য, নিজের ঢাক ঢোল নিজেই পিটিয়ে যাওয়া সাহিত্য, কান্নাকাটিতে ভরা আত্মজীবনী – কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছুই হস্তমৈথুন করতে গিয়ে শীর্ষসুখে পৌঁছানোর আগেই থেমে যাওয়ার মত। সত্যিকারের সাহিত্যের কাজ হচ্ছে মনস্তাত্বিক, আবেগপূর্ণ, এবং সামাজিক সত্য ঘটনাকে তুলে ধরা। যেখানে নায়কের নানা কাজকর্ম, পদক্ষেপ আর চিন্তাভাবনার মধ্যে ওই সব ফুটে উঠবে। আর উপন্যাস হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক একটা চরিত্রের গল্প। তা সে যাই হোক না কেন, ফিল ডিস্কন আমাদের এমনটাই বলেছিলেন। আর তা ছাড়া একমাত্র যার জীবন কিছুটা সাহিত্যের মত ছিল – রবসন ছাড়া – যার জীবন কিছুটা হ’লেও সাহিত্যের উপাদানের উপযুক্ত ছিল সে হ’ল এডরিয়্যান।
“তোর মা তোর বাবা-কে ছেড়ে চ’লে গেল কেন রে?”
“কি জানি, ঠিক জানি না তো।”
“তোর মা’র অন্য কোন প্রেমিক ছিল বুঝি?”
“তোর বাবা আসলে এক ব্যভিচারী স্ত্রীর স্বামী ছিল, তাই না?”
“তোর বাবা-র কোন রক্ষিতা ছিল?”
“আমি কিছুই জানি না। ওরা আমাকে বলেছে যে যখন আমি বড় হ’ব তখন সব বুঝতে পারব।”
“হুঁম, সবসময় ওঁরা এই প্রতিশ্রুতিই দেয়। কিন্ত এই এখন এইসবের ব্যাখ্যাটা দিলে ক্ষতিটা কি শুনি? আমি তো তাই ব’লি। তবে ঘটনা শুধু এই যে আমি কোনদিন এ কথা কাউকে বলতে পারি নি। আমি যতটুকু জানি, কোথাও কোনদিন আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা কোন রহস্যই ছিল না। এবং তা ছিল আমার সব লজ্জ্বা আর আশাভজ্ঞের কারণ।”
“হয়ত তোর মা’র কোন অল্পবয়সী প্রেমিক আছে।”
“আমি কিভাবে জানব? আমি কখনো তো ওখানে দেখা করতে যাই না। মা নিজেই সবসময় এখানে, লন্ডনে দেখা করতে আসেন।”
নাহ্‌, এইসব নিরাশ করা কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। উপন্যাসের এডরিয়্যান কখনোই ঠিক যা তার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত না। প্রায় গল্পের বই-এর উপযুক্ত মাল মশলা ভরা জীবন থেকে লাভটাই বা কি, যদি না স্বয়ং নায়ক চরিত্রটি এমন কোন আচরণই না করে যা কিনা বই-এর পাতায় সে করে থাকে? এডরিয়্যানের অবশ্যই উচিত ছিল এই বিষয়ে নাক গলানো। কিংবা নিজের হাত খরচের টাকা জমিয়ে উচিত ছিল গোয়েন্দা ভাড়া ক’রা; কিংবা হয়ত আমাদের চারজনেরই সত্য খুঁজে বের করবার জন্য বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল । অবশ্য হয়ত তেমন টা ক’রলে তা একেবারেই সাহিত্যের মত হ’ত না, বরং খুব বেশি রকম বাচ্চাদের জন্য লেখা কোন গল্পের মত হ’য়ে যেত?

(চলবে...)





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন