শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৪

দ্যা সেন্স অফ অ্যান এন্ডিং(১)

বাংলামাটি-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতঃ


(এক)

মনে পড়ছে। তবে কিসের পর যে কী, তা ঠিক মনে নেই:
-এক চকচক করা হাতের কব্জির ভিতরের দিকটা ;
-ভেজা সিঙ্ক থেকে ধোঁয়া উঠছে,হাসতে হাসতে কেউ গরম তাওয়া-টা সিঙ্কে নামিয়ে রেখেছে;
-প্লাগহোলে বীর্যের ফেনা ঘুরছে, এক লম্বা দালানের সমান পথ বেয়ে তোড়ে বেড়িয়ে যাবার আগে;
-একটা নদী আজব-ভাবে উজানে ছুটে চলেছে। খান ছয়েক টর্চের তাড়া করে খুঁজে মরা, ছুটে আসা সুতীব্র আলোয় আলোকিত নদীর ঢেউ, ধুয়ে যাওয়া জল;
-অন্য আর এক নদী, প্রশস্ত এবং ধূসর। এক একগুঁয়ে বাতাস জলের উপরটাতে এমন কাঁপন তুলেছে যে বোঝা যাচ্ছে না নদীটা ঠিক কোনদিকে বয়ে যাচ্ছে;
-বন্ধ দরজার পিছনে স্নানের জল অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে;
এই শেষ ছবিটা আমি সত্যি সত্যিই দেখেছিলাম, তা ঠিক নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কথা আমাদের মনে থাকে, এমন তো নয় যে তেমনটাই ঘটেছিল।

আমরা সময়ের ভিতর বাস করি-সময় আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখে, আমাদের ছাঁচে ঢেলে তৈরী করে - কিন্তু কোনদিনই মনে হয় না সময়কে আমি খুব একটা ভালো বুঝতে পেরেছি । এবং আমি সেই তত্ত্বকথার আশেপাশেও যাচ্ছি না যেখানে সময় বেঁকে গিয়ে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে, কিংবা অন্য কোথাও এক সমান্তরাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। না, আমি বলতে চাইছি সেই সময়ের কথা যে সময় প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের, যে সময় ঘড়ির কাঁটায় সহজভাবে, নিয়মমত আমাদের পাশ দিয়ে পার হয়ে যেতে গিয়ে শুধু বলে যায়ঃ টিক-টক, ক্লিক-ক্লক। ঘড়ির দ্বিতীয় কাঁটার থেকে চরম আর কোন সত্য আছে কি? অথচ তবুও সময়ে যে সব মানিয়ে নেয়া যায় তা আমাদের শেখানোর জন্য শুধুমাত্র সবচেয়ে ছোট কোন আনন্দ কিংবা বেদনাই যথেষ্ট। কোন কোন অনুভূতি তাকে ত্বরান্বিত করে, কোনটা বা মন্থর করে; হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় হয়ত বুঝি বা তা হারিয়েই গেল। এবং একসময় সেই চূড়ান্ত মূহুর্তটি আসে যখন সময় সত্যিই হারিয়ে যায়, এবং তারপর কোনদিন আর ফিরে আসে না।

ছেলেবেলার স্কুলের দিনগুলো আমাকে যে খুব একটা আকর্ষণ করে, তা নয়; আসলে সেই দিনগুলোর জন্য কোন নস্ট্যালজিয়া-ও আমি কখনো বোধ করি না। কিন্তু স্কুলেই এই সব কিছু শুরু হয়েছিল, তাই অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছু ঘটনাতে ফিরে যেতে চাই যা শেষে হাস্যকর কিছু গল্পতেই পরিণত হয়েছিল। ফিরে যেতে চাই সেইসব স্মৃতিতে যার ভিতর কিছু কিছু হয়ত সত্য ছিল, কিন্তু সময় সেগুলোকেই বিকৃত করে একেবারে ধ্রুব সত্য করে তুলেছে। আসলে সেই সব ঘটনার সত্যতা নিয়ে পুরোপুরি আর নিশ্চিত না হতে পারলেও, হয়ত আজ আমি সেইসব গল্প মনের ভিতর যে ছবি এঁকে গেছে শুধু তার প্রতিই বিশ্বস্ত হতে পারি। হয়ত এখন শুধু সেটুকুই আমার নিয়ন্ত্রণে।

আমরা বন্ধু ছিলাম তিনজন। এবং ও আসায় আমরা হয়ে গেলাম চারজন। এই সংখ্যাটা বাড়ানোর বিষয়ে খুব একটা যে উৎসাহ বোধ করছিলাম তা নয়ঃ আসলে মিল-অমিল এবং সব অন্তরঙ্গতার বুনিয়াদ আমাদের মধ্যে অনেক আগেই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। আর আমরাও স্কুল থেকে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী সত্যিকারের জীবনের কথা কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। ওর নাম ছিল এডরিয়্যান ফিন, লম্বা, লাজুক এক ছেলে, প্রথমদিকে চোখ মাটির দিকে করেই থাকত, আর সব ভাবনাগুলোকে সবসময় নিজের ভিতরই রাখত। প্রথম এক কি দুদিন আমরাও ওকে খুব একটা লক্ষ্য করি নিঃ আর আমাদের স্কুলেও নতুন কাউকে সত্যিকারের অভ্যর্থনা জানিয়ে তো কিছু করা হত না। বরং যা হত তা ছিল ঠিক তার উল্টো। শাস্তি দেওয়ার মত করে কাউকে বরণ করে নেওয়া। আমরা শুধু ওর উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম, আর তারপর অপেক্ষা করতে থাকলাম।

আমাদের থেকে শিক্ষকরাই ওকে নিয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। ওর বুদ্ধি, নিয়মানুবর্তিতা, এর আগে ঠিক কতটা ভালো শিক্ষা পেয়েছে, ‘বৃত্তি পাওয়ার যোগ্যকী না এইসব তাঁরা মাপজোখ করে দেখতে শুরু করলেন। সেই অটাম টার্মের তৃতীয় দিন সকালবেলা, বুড়ো জো হান্ট-এর সাথে আমাদের একটা ইতিহাসের ক্লাশ ছিল। তাঁর থ্রি-পিস স্যুটে কষ্টেসৃষ্টে এক অমায়িকভাব দেখিয়ে সেজেগুজে তিনি তো এলেন। এই শিক্ষকের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার পদ্ধতিটি ছিল অনেকটা এমনতরো উনি ঠিক এমনভাবেই পড়াতেন যাতে ছাত্ররা খুব অতিরিক্ত না হলেও, যথেষ্ট পরিমাণেই এক একঘেয়ে, অসহনীয় বিরক্তিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত।

তা সকলের নিশ্চয় মনে আছে যে আমি তোমাদের অষ্টম হেনরীর রাজত্বর উপর কিছু প্রাথমিক পড়াশোনা করতে বলেছিলাম।কলিন, এ্যালেক্স আর আমি নিজেদের মধ্যে চোখ টেপাটেপি করলাম, ভাবখানা যেন প্রশ্নটা বড়শির টোপের মত টুপ করে আমাদের কারো মাথার দিকেই না এগিয়ে আসে। ওই যুগের একটা চিত্র কে ফুটিয়ে তুলতে পারবে?” আমাদের এড়িয়ে যাওয়া চোখের দৃষ্টি দেখে উনি নিজেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন। হয়ত মার্শাল আমাদের কিছু বলতে পারবে। তা তুমিই বল দেখি, কিভাবে অষ্টম হেনরীর রাজ্বত্বকাল-কে চিহ্নিত করবে?”

আমাদের স্বস্তির নিশ্বাস আমাদের সদা উৎসুকভাবের চেয়ে বেশি ছিল, কেননা মার্শাল ছিল এমন এক পদার্থ যে কিনা কিচ্ছু না জেনেও সতর্কভাবেই উত্তর দিয়ে যেতে পারত। সত্যিকারের অজ্ঞতার উদ্ভাবনী শক্তি ওর ভিতর বড়ই কম ছিল। ও প্রশ্নটার ভিতর লুকিয়ে থাকা সব সম্ভাব্য জটিলতাগুলো খুঁজে দেখে শেষে এই এক উত্তর খাড়া করল।

তখন সামাজিক, রাজনৈতিক বিক্ষুব্ধতা ও অশান্তি ছিল, স্যার।
আমাদের আর চেপে রাখতে না পারা হাসি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল; হান্ট-ও প্রায় হেসেই ফেললেন।
তুমি কি আর একটু বিস্তারিতভাবে, পরিষ্কারভাবে আমাদের বুঝিয়ে বলতে পারবে?”

মার্শাল ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, আর একটু ভাবল, তারপর অবশেষে ঠিক করেই ফেলল যে, নাহ্‌, এ আর সর্তকভাবে উত্তর দেওয়ার সময় নয়। তা আমি বলব যে তখন অস্বাভাবিক সামাজিক, রাজনৈতিক বিক্ষুব্ধতা এবং অশান্তি ছিল, স্যার।

ঠিক আছে, তবে ফিন এবার তুমি বল দেখি। এই বিষয়ে তোমার একটা মতামত তো আছে নিশ্চিত।
নতুন ছেলেটি এক সারি আগে, আমার বামদিকে বসেছিল। ও মার্শালের নির্বুদ্ধিতা দেখে কোন সুস্পষ্ট, লক্ষণীয় প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

দুঃখিত স্যার। খুব একটা যে মতামত দিতে পারব তা ঠিক নয়। তবে এ বিষয়ে একটা এ ধরণের ধারণা আছে যে যার উপর ভিত্তি করে সত্যিকারভাবে অনায়াসেই যেটা বলা যায় তা হল সেটা যে কোন ঐতিহাসিক ঘটনার জন্যই সত্য-এমন কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিষয়েও এই একই কথা বলতে পারি আমরা। এই যেমন ধরুন উদাহরণস্বরূপ যেটা আমরা বলতে পারি তা হ– ‘কিছু একটা ঘটেছিল।

ওহ্‌, তাই নাকি? তবে তো এই চিন্তাধারা আমার রুজিরোজগারের পথই বন্ধ করে দেবে দেখছি।কিছুক্ষণ হাসাহাসির পর বুড়ো জো হান্ট আমাদের ছুটি কাটানোর ঠিক পর পরই যে অলসভাব দেখা যায় তা ক্ষমা করে দিয়ে ওই বহু নারীতে আসক্ত, রাজকীয় কশাইটার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করলেন।

ক্লাশের পরের বিরতির সময়, আমি ফিন-কে খুঁজে ওর কাছে গেলাম। আমি টনি ওয়েবষ্টার।ও আমার দিকে সর্তকভাবেই তাকাল। হান্টকে দারুণ একটা লাইন দিয়েছ হে।ওর ভাব দেখে মনে হল যেন ঠিক বুঝতে পারছে না আমি কিসের কথা বলছি। ওই যে কিছু একটা ঘটেছিল।

ও হ্যাঁ, তা আমি আসলে বেশ একটু হতাশই হয়েছিলাম উনি সেই চালটা খেলেন না বলে।

ওর ঠিক এমন একটা উত্তর দেওয়ার কথা ছিল না।

আর একটা ঘটনার কথা বিস্তারিত মনে আছেঃ আমরা তিনজন আমাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবে হাতঘড়িটা হাতের কব্জির ভিতরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পড়তাম। এটা একটা কায়দা তো অবশ্যই ছিল, কিন্তু হয়ত যেন ছিল তার থেকেও বেশি অন্য আর কিছু। আমাদের মনে হত সময় এক ব্যক্তিগত, আমাদের খুব নিজস্ব, গোপন একটা বিষয়। আমরা আশা করেছিলাম এডরিয়্যান-ও আমাদের দেখাদেখি এই একই পথ বেছে নেবে; কিন্তু এডরিয়্যান তা করেনি। ওই পথে সে যায়নি।

(চলবে)





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন