মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল, ২০১৪

'দ্যা সেন্স অফ অ্যান এন্ডিং' (৩)


মূলঃ
জুলিয়ান বার্নস

অনুবাদঃ কল্যাণী রমা

সেইসব দিনগুলোতে মনে হত আমাদের বুঝি কোন একটা খোঁয়াড়ে আটকে রাখা হয়েছে। সত্যিকারের জীবনে ছাড়া পাওয়ার আগে এখানে সবাই অপেক্ষা করছি। আর যখন সেই মুহুর্তটি আসবে, আমাদের জীবন এবং সময় তখন যেন সব নিজের নিয়মেই গতি পেয়ে উঠবে। অথচ কিভাবে জানব যে আমাদের জীবন আসলে শুরু হয়ে গেছে, কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়েছি, কিছু ক্ষতি ইতিমধ্যেই জীবনে হানা দিয়ে গেছে? তাছাড়া, এই ছোট খোঁয়াড়, এই খাঁচা থেকে আর একটু বড় কোন খাঁচা বা খোঁয়াড়েই না ছেড়ে দেওয়া হ’বে আমাদের হয়ত প্রথমে যার সীমানা ভালোভাবে বোঝা যাবে না, চোখ দিয়ে দেখা যাবে না, কিছুতেই উপলব্ধি করা যাবে না কিছু
ইতিমধ্যে, আমরা বই-এর ক্ষুধায়, যৌন-ক্ষুধায় পিপাসার্ত হয়ে উঠেছিলাম। হয়ে উঠছিলাম বিশৃঙখলটাকা-পয়সা, সামাজিক অবস্থান সবকিছুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলছিলাম শুধু বুদ্ধি আর প্রতিভাকে মূল্য দিয়ে। সব রাজনৈতিক আর সামাজিক ব্যবস্থা আর পদ্ধতিকে কলুষিত আর দুর্নীতিতে ভরা বলে মনে হচ্ছিল তবু বিশৃঙ্খলায় ভরা সুখের পথ ছেড়ে আমরা অন্য কোন পথই বেছে নিই নি। যদিও এডরিয়্যা আমাদের ঠেলেঠুলে বিশ্বাস করিয়েই ছেড়েছিল যে ন্যায়-নীতিই শেষ পর্যন্ত জীবনের চলার পথ ঠিক করে দেয়। আগে আমাদের মধ্যে দার্শনিক ছিল এ্যালেক্স আমরা বাকি দু’জন পড়ে উঠিনি, এমন সবকিছু এ্যালেক্স পড়ে বসেছিল। এমনকি মাঝে মাঝেই থেকে থেকে সে ঘোষণা দিয়ে উঠত, ‘যখন  বলবার মত কিছু থাকে না, তখন আমাদের চুপ ক’রে থাকাই ভাল।কলিন আর আমি কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে চুপচাপ ভাবতাম, তারপর হেসে সব উড়িয়ে দিয়ে যে কে সেই আমাদের গল্প-গুজবে মেতে উঠতাম। কিন্তু এখন এডরিয়্যা-এর আগমন এ্যালেক্স-কে যেন তার স্থান থেকে পদচ্যুত করে দিল। কিংবা হয়ত বলা যায় যে আমাদের আর একজন দার্শনিককে পছন্দ করে বেছে নেওয়ার সুযোগ হ’য়ে গেল এ্যালেক্স যদি রাসেল আর উইটগেনস্টাইন পড়ে থাকে, এডরিয়্যা পড়ে বসে আছে কামু আর নিত্‌সে। আমি জর্জ অরওয়েল আর আল্ডাস হাক্সলি পড়েছি; কলিন পড়েছে বদ্‌লেয়ার আর দস্তয়েভস্কি। সত্যি কথা বলতে কি আসলে এইসব ছিল শুধুই ঠাট্টা তামাসা।
হ্যাঁ, আমরা দাম্ভিক ছিলাম - তারুণ্য তা না হ’লে আর কিসের জন্য? আমরা কথায় কথায় পৃথিবীর প্রতি ব্যক্তিগত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে জার্মান শব্দ ওয়েলতানসাউআর জীবনের উত্তেজনা, বিশৃঙ্খলা বোঝাতে স্টার্ম আন্ড ড্রাংব্যবহার করতাম। এটা দার্শনিকভাবে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান।  একজন আর একজনকে এই বলে নিশ্চিত করতাম যে কল্পনাশক্তির প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সব সীমা, সব বাধা পেরিয়ে যাওয়া। বিশেষ ক’রে সামাজিক গ্রহণযোগ্য সব নিয়ম-কানুন অবজ্ঞা করাই যেন আমাদের কাজ আমাদের বাবা মা-রা কিন্তু অন্যভাবে জিনিষগুলো দেখতেন। ভাবতেন তাদের সন্তানেরা সব নির্মল, নিষ্পাপকিন্তু হঠাত্‌ করে যেন অনিষ্টকর, অশুভ সব প্রভাবের মুখোমুখি হ’য়ে পড়েছে। কলিনের মা মনে করতেন আমি যেন ওর জীবনে এক অন্ধকারের দূত। আমার বাবা যখন দেখলেন আমি কমুনিষ্ট ম্যানিফেষ্টোপড়ছি, তখন তার জন্য তিনি এ্যালেক্স-কে দায়ী করলেন। এদিকে যখন এ্যালেক্স-এর বাবা মা ওকে আমেরিকান রগরগে রহস্যোপন্যাস পড়া অবস্থায় হাতে-নাতে ধরলেন, সব দোষের জন্য কলিনের দিকেই ওঁনাদের অঙ্গুলি ঘুরে গেল। এবং এইভাবেই চলতে থাকল। একই ঘটনা যৌনতা নিয়েও। আমাদের বাবা মা-রা মনে করতেন আমরা একজন আর একজন-কে কলুষিত করে ফেলব। যে পরিণতিকে ওনারা সবচাইতে ভয় পেতেন, যেন সেটাই হয়ে উঠবে আমাদের নিয়তি। স্বমেহন ছাড়া আমরা যেন কিছুই আর বুঝব না। হয়ে উঠব আকর্ষণীয়, উজ্জ্বল চেহারার সমকামী। হয়ে উঠব বেপরোয়া, মুক্ত, স্বাধীন। বয়ঃসন্ধিকালের সব ঘনিষ্ঠতাকে, অন্তরঙ্গঃ বন্ধুত্বকে ওঁনারা আতঙ্কের চোখে দেখতে শুরু করলেন। আর সেইসবই নাকি আমাদের স্বার্থে। ট্রেনে অজানা, অচেনা লোকজনের শিকারিসুলভ ব্যবহার, ভুল-ভাল মেয়েদের প্রলোভন বড় বেশি ভাবিয়ে তুলত তাঁদের। এবং তাঁদের এইসব দুশ্চিন্তা খুব সহজেই শেষমেষ আমাদের অভিজ্ঞতা-কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

এক বিকেলে, বুড়ো জো হান্ট আমাদের প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধের সূত্রপাত নিয়ে বিতর্কে নামতে বললেন। ভাবখানা যেন উনি এডরিয়্যা-এর আগের বক্তব্য-র বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামছেন। আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফারদিনান্দ-এর গুপ্তঘাতকই এই যুদ্ধ শুরু করবার মূলে- বিশেষভাবে এই নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে বললেনসেই সময়ে, আমরা সবাই ছিলাম মোটামুটি চরম স্বাধীনচেতা উত্তর হিসাবে না’-এর বদলে আমরা হ্যাঁবলতে ভালোবাসতাম।নিন্দা’-র বদলে প্রশংসা, অপরাধবোধ-এর বদলে নির্মল, নিষ্পাপ জীবন। কিংবা মার্শাল-এর ক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধতা-র বদলে চরম বিক্ষুব্ধতা। আমরা সেইসব খেলা ভালোবাসতাম যা হয় জয় কিংবা পরাজয়ে শেষ হত। অমীমাংসিত অবস্থায় একেবারেই নয়। এবং এইসবের জন্য সেই সার্বিয়ান বন্দুকধারীই যেন প্রায় সম্পূর্ণ একশভাগ দায়ী। অথচ তার নাম বহুদিন আগেই আমার স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলওকে হিসাবের বাইরে নিলে কোন যুদ্ধই যেন হত না। অন্যরা অবশ্য ঐতিহাসিক ওইসব সেনাবাহিনীর একশভাগ দায়-দায়িত্বকে বেশ ভালোই পচ্ছন্দ করত যদিও তা শত্রুভাবাপন্ন, বিরোধী জাতিগুলোকে এক অনিবার্য সংঘর্ষের পথে নিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপ পিপায় ঠাসা বারুদ গুঁড়ার মত যেন শুধু অপেক্ষা করছে কখন বিস্ফোরিত হবে” - এবং এভাবেই অন্য আর সবকিছু। যারা কলিনের মত অসম্ভব রকম নৈরাজ্যবাদী, তারা যুক্তি তর্ক ক’রে প্রমাণ করল যে শেষপর্যন্ত সবকিছুই আসলে ভাগ্যের খেলা। পৃথিবীর অস্তিত্ব এক অন্তহীন নৈরাজ্যের ভিতর। এবং গল্প বলবার যে সহজাত আদিম অভ্যাস – নিশ্চিন্তভাবেই বলা যায় যে তা ফেলে আসা ধর্মের রেশ ছাড়া আর কিছু নয়। কি হ’তে পারত আর কি না হ’তে পারত – এই সবই অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে চাপিয়ে দেওয়া বক্তব্য।
কলিনের সবকিছুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবার সব প্রচেষ্টায় হান্ট অল্প সম্মতি সূচক মাথা নাড়াতেনযেন বীভত্‌স নাস্তিকতা এবং অবিশ্বাস বয়ঃসন্ধিকালের ধর্ম, তারুণ্যের এক স্বাভাবিক উপজাত বৈশিষ্টএকসময় যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবে সকলেই। এদিকে আমাদের শিক্ষক এবং বাবা মা-রা বিরক্তকরভাবে সবসময়ই শুধু মনে করাতেন যে তাঁরাও একদিন তরুণ ছিলেন। তাই অভিজ্ঞতার আলোকেই সব বলছেন। খুব জোর দিয়ে তাঁরা বলতেন - এইসব জীবনের শুধু একটা পর্যায়। ধীরে ধীরে তোমরা সবাই বড় হ’বে, সমস্তকিছুকে পিছনে ফেলে। সব ভাবপ্রবণতা কাটিয়ে জীবন তোমাদের বাস্তবকে চিনতে শেখাবে। কিন্তু তখনকার সেইসব দিনে তাঁরা যে কখনো কোনভাবে অল্প হ’লেও আমাদের বয়সী ছিলেন – কিছুতেই আমরা তা স্বীকার করতে রাজি ছিলাম না। ভাবতাম কেবল যেন আমরাই জীবনকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি সততা, নৈতিকতা আর শিল্পকলার সঠিক মানে। আর সবকিছুই যেন বুঝতে পেরেছি আমাদের কথায় কথায় আপোস ক’রা বয়োজ্যেষ্ঠদের থেকে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে।
“ফিন, তুমি যে বড় চুপচাপ। এই আলোচনা তো তুমিই শুরু করেছিলে। তুমি অনেকটা সেই সার্বিয়ান বন্দুকধারীর মত।” হান্ট কথার মাঝে অল্প বিরতি দিলেন। যেন এই উদাহরণটুকু সকলে একটু ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। “তোমার চিন্তাভাবনার কিছুটা আমাদেরকে বলবে নাকি?”
“আমি জানি না, স্যার।”
“কি জান না তুমি?”
“হুঁম, প্রথমতঃ আমি জানি না যে কি আমি জানি না। দর্শনের দিক থেকে দেখতে গেলে সেটা পরস্পর বিরোধী কথা” এই ব’লে সে খানিকক্ষণ চুপ ক’রে থাকল। আর তাতে আমরা আবার ভাবতে থাকলাম যে সে কি আমাদের হালকা উপহাস ক’রল নাকি এমন কোন গুরুগম্ভীর কিছু বলল যা কিনা আমাদের সকলের বোধশক্তির বাইরে। “আর সত্যি বলতে কি দায়িত্ব আরোপ করবার এই পুরো ব্যাপারটাই শেষ পর্যন্ত এক ধরণের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া নয় কি? আমরা কোন একজনকে বিশেষভাবে দোষারোপ করতে চাই যেন অন্য আর সবাই সব ধরণের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। কিংবা আমরা দোষারোপ করি কোন একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে যেন কোন বিশেষ ব্যক্তি মুক্তি পেতে পারে। অথবা এইসবই কেবলমাত্র বিশৃংখলা আর নৈরাজ্য। এবং শেষ পর্যন্ত সবকিছুর পরিণতি সেই একই। আমার কাছে মনে হয় এ যেন এই আছে কিংবা এই যেন ছিলসবকিছুই যেন একের পর এক কোন এক স্বতন্ত্র ব্যাক্তির জীবনে দায়িত্বের বাঁধন হতে পারতকিন্তু ঠিক এতটাই বাঁধন নয় যে প্রত্যেকে শেষমেষ একে অপরকে দায়ী করতে পারেঅবশ্য এমনটা হতেই পারে যে আমার দায়িত্ব আরোপ করবার এই দুরন্ত ইচ্ছা আসলে ঠিক কি হয়েছিল তার একটা পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণের বদলে আমার মনের চিন্তা ভাবনারই এক প্রতিফলন। স্যার, ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগূলোর মধ্যে এটাই প্রধাণ বিষয়, তাই নয় কি? আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যে মনোগত এবং বাস্তব ব্যাখ্যার পার্থক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে যে প্রশ্ন। ঐতিহাসিকদের ইতিহাস- প্রথমতঃ এই তথ্যই খুঁজে বের করতে হবে  আমাদের। কেবলমাত্র তবেই আমাদের সামনে যে দৃষ্টিকোণ, যে ভাষ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে তা পুরোপুরি বুঝতে পারব আমরা
এরপর নীরবতা কিছুক্ষণের জন্য। নাহ্‌, অল্পক্ষণের জন্য হ’লেও সে কোন রকম বিচলিত হ’ল না। পাত্তাই দিল না কোনকিছুকে।
বৃদ্ধ জো হান্ট নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেনতারপর অল্প হেসে বললেন, “ফিন্‌, আমি আর বছর পাঁচেকের মধ্যে অবসর গ্রহণ ক’রব। এবং তুমি যদি চাও আমার পদটি নিতে পার, আমি খুব খুশি হয়েই তোমাকে প্রশংসাপত্র দেব” এ কথাও সে কোনরকম গায়ে মাখল না।   





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন