সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০১৪

'দ্যা সেন্স অফ অ্যান এন্ডিং' (২)


মূলঃ জুলিয়ান বার্নস
অনুবাদঃ কল্যাণী রমা

পরে, সেই দিন কিংবা হয়ত অন্য কোন একদিন ফিল ডিক্সন-এর সাথে আমাদের এক ডাবল ইংলিশ পিরিয়ড ছিল। ক্যাম্ব্রিজ থেকে মাত্র এসেছেন এই তরুণ শিক্ষক। উনি সমসাময়িক লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে ভালোবাসতেন। আর হঠাৎ হঠাৎ মোক্ষম সব প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিতেন। “‘জন্ম, সঙ্গম আর মৃত্যু’– টি এস এলিয়ট-এর মতে এই হচ্ছে সবকিছুর মূলে। এ বিষয়ে কারো কিছু বলবার আছে কি?” উনি একবার এক শেক্সপীরিয়ার-এর নায়ক-কে স্পার্টাকাসের কার্ক ডগলাসের সাথে তুলনা করেছিলেন। আর মনে পড়ে  আমরা যখন টেড হিউজের কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, উনি কিভাবে মহাবিজ্ঞের মত মাথাটা কাত করে, বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “আমরা সকলেই নিশ্চয় ভাবছি যখন এইসব জন্ত-জানোয়ারগুলো ফুরিয়ে যাবে, তখন কী হবে?” কখনো কখনো উনি আমাদের জেন্টলম্যানলে সম্বোধন করতেন। স্বভাবতঃই, আমরা ওঁনাকে ভীষণ পছন্দ করতাম।
সেদিন বিকালবেলা, উনি একটি কবিতা ধরিয়ে দিলেন। কোন শিরোনাম, তারিখ বা লেখকের নাম নেই কবিতায়। আমাদের মিনিট দশেক সময় দিলেন কবিতাটা খুঁটিয়ে পড়ে দেখতে, তারপরই  প্রতিক্রিয়া জানতে প্রশ্ন শুরু
ফিন, তোমাকে দিয়ে শুরু করব কি? খুব সহজভাবে বলতে গেলে এই কবিতাটা ঠিক কী নিয়ে লেখা হয়েছে বলে তোমার মনে হ?”
এডরিয়্যান ডেস্কের থেকে চোখ তুলে তাকাল ইরোস আর থানাটোস, স্যার।
হুম, তারপর?”
যৌন-ক্ষুধা আর মৃত্যু,” ফিন বলে চলল, পাছে পিছনের সারিতে বসে থাকা মাথা মোটাগুলোর মগজে গ্রীক না কুলায়। কিংবা যদি চান, বলতে পারেন প্রেম ও  মৃত্যু। তা যে ভাবেই ভাবুন না কেন, মৃত্যুর সব সূত্রর বিপরীতেই এসে দাঁড়াচ্ছে যৌন-আকাঙ্খার তত্ত্ব আর সেই বিরোধ থেকেই পরবর্তী আর সব ঘটনাপ্রবাহ, স্যার।
হয়ত ডিক্সন ঠিক যতটুকুকে স্বাস্থ্যকর মনে করেন, তার থেকে আমাকে বেশি অভিভূত দেখাচ্ছিল।
ওয়েবষ্টার, আমাদের আরো একটু আলোকিত করতে যদি।
স্যার, আমি আসলে ভাবছিলাম এই কবিতাটা গোলাঘরের একটা প্যাঁচাকে নিয়ে লেখা।
এই ছিল আমাদের তিনজনের আর নতুন বন্ধুটির ভিতর নানা পার্থক্যের একটি মূলতঃ হাসি, ঠাট্টা, তামাসাই আমাদের জীবনের প্রধান ছিল। শুধু অল্প কিছু গুরুগম্ভীর সময় বাদে। অন্যদিকে এডরিয়্যান ছিল সবসময়ই গুরুগম্ভীর শুধু কিছু হাসি, ঠাট্টার সময় বাদে। এই ব্যাপারটার সাথে খাপ খাওয়াতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিল।
এডরিয়্যান আমাদের দলে ভিড়ে গেল, ও যে আমাদের সঙ্গ চায় তা নিজের কাছে স্বীকার না করেই। কী জানি কে বলতে পারে হয়ত ও সত্যি সত্যিই আমাদের সঙ্গ চায়নি। অবশ্য আমাদের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেকে বদলায় নি ও। স্কুলে ভোরবেলার প্রার্থনা-সভায় ওকে যোগ দিতে দেখা গেল ঠিক যখন আমি আর এ্যালেক্স কোনমতে শুধু মুখ নেড়ে শব্দগুলো বলে যাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম আর কলিন ব্যঙ্গ করে এক অতি উৎসাহীর ভন্ড কূটচাল চালছিল। আমরা তিনজনই স্কুলের খেলাধূলাকে আমাদের সব যৌন উত্তেজনা দমিয়ে রাখবার এক দুর্বোধ্য, বিকৃত ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনা বলে মনে করতাম। এডরিয়্যান ফেন্সিং ক্লাবে যোগ দিয়েছিল, হাই জাম্প দিত ও। আমরা চরমভাবে সুর-তাল কানা ছিলামএডরিয়্যান স্কুলে ওর ক্ল্যারিনেট নিয়ে আসত। যখন কলিন পরিবারের প্রয়োজনীয়তাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করল, আমি সব রাজনৈতিক মতাদর্শকে তুচ্ছ করে ব্যঙ্গ করতে শুরু করলাম, আর এ্যালেক্স বাস্তব জগতের আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হওয়া সত্যতার ত্রুটি বিষয়ে দার্শনিক মতবাদ দিতে শুরু করলএডরিয়্যান ওর নিজ মনোভাব গোপনই রেখেছিল। অন্ততঃ প্রথমদিকে তেমনই মনে হয়েছিল আমাদের ও জগত সংসারে আস্থাবাদী ও বিশ্বাসী বলেই সকলের কাছে নিজের পরিচয় দিত বিশ্বাসী আমরাও ছিলাম শুধু আমাদের বিশ্বাস ছিল নিজেদের পছন্দসই বিষয়ে, যার উপর আস্থা রাখতে হবে বলে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হত তার উপর একেবারেই নয়। একেই আমরা আমাদের শুদ্ধ সংশয়বাদীতা বলে মনে করতাম।
আমাদের স্কুল ছিল মধ্য লন্ডনে। প্রতিদিন আমরা আলাদা আলাদা, নিজ নিজ শহর থেকে ওখানে যেতাম। এক শাসন আর নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল টপকে অন্য আর এক বেড়াজালের ভিতর। তখনকার দিনে জীবন খুব সহজ-সরল ছিল সকলের কাছে স্বল্প টাকা-পয়সা, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলে, ফ্যাশনের  অত্যাচার অল্প, জীবন নারীবন্ধুহীন মনুষ্য-ধর্ম ও কর্তব্য থেকে আমাদের বিপথে নিয়ে যাওয়ার জন্য ত্রিসীমানায় কোন কিছুই ছিল না। আমাদের সন্তানোচিত কাজ ছিল কেবল পড়াশোনা করা, পরীক্ষা পাশ করা, আর সেইসব যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে কোন একটা চাকরি যোগাড় করা। তারপর এমন এক জীবনযাপন করা যা আমাদের বাবা মা-দের জীবনের থেকে আশংকাহীনভাবে সবদিক থেকেই যেন পরিপূর্ণ আমাদের জীবনের পথে বাবা মা-দের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। ওনারা গোপনে নিজেদের অল্পবয়সের সাথে আমাদের জীবন মিলিয়ে দেখতেন, এবং মনে করতেন তাঁদের জীবন যেহেতু তুলনামূলকভাবে সহজ-সরল ছিল, তাই যেন তা অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। এইসব কিছু অবশ্য কোনদিনই প্রকাশ্যে বলা হত না - ইংরেজ মধ্যবিত্ত জীবনের টিকে থাকবার এই ভদ্র, পরিশীলিত সামাজিক ডারউইনবাদ খুব সূক্ষ্ণভাবে আকারে ইঙ্গিতেই সব সময় প্রকাশিত হত।
বাবা মা-গুলো সব ফাকিং বাস্টার্ড,” এক সোমবারে দুপুরের খাওয়ার সময় অভিযোগ তুলল কলিন।
ছেলেবেলায় মনে হয় যে ওরা সব ঠিকঠাকই আছে। তারপর বোঝা যায় যে ওদের সকলেই আসলে...
অষ্টম হেনরী, কল্‌?” এডরিয়্যানের প্রস্তাব। আমরা ওর রসিকতায় অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলাম; এমনকি এমনটা জেনেও যে সে রসিকতা হয়ত এক সময় আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হতে পারে। ঠাট্টা করবার সময় কিংবা আমাদের মনোযোগ কাড়বার সময়গুলোতে ও আমাকে এ্যান্থনি বলে ডাকত। এ্যালেক্স হয়ে যেত আলেক্সান্দার, আর ছোটখাট নামের কলিন কল্‌।
আমার বাবার ছয় ছয়খান বউ থাকলেও কিছুই মনে করতাম না।
আর বিশাল বড়লোক হলে।
কিংবা হব্যান তাঁর পোট্রেট আঁকলে।
এবং তিনি পোপকে নস্যাৎ করে দিলে।
বাবা মা-কে ফাকিং বাস্টার্ডভাববার পিছনে কোন বিশেষ কারণ আছে কি?” এ্যালেক্স কলিনকে জিজ্ঞাসা করল।
সবাই মিলে মেলাতে যেতে চেয়েছিলাম। না, তাঁরা জানালেন উইকেন্ডটাতে তাঁদের বাগান করে কাটাতে হবে।
ঠিক - ফাকিং বাস্টার্ড। এক এডরিয়্যানের কাছে ছাড়া। ও আমাদের অভিযোগুলো শুনে যেত, কিন্তু খুব কমই তাতে যোগ দিত। আমাদের যদিও মনে হত ওরই যেন জীবন নিয়ে অভিযোগ করবার সবচেয়ে বেশি কারণ ছিল। ওর মা বহু বছর আগে ওদের ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন বাবার হেফাজতে এডরিয়্যান আর ওর বোনকে ছেড়ে দিয়ে। সিংগল প্যারেন্ট ফ্যামিলিকথাটা চালু হবার অনেক আগের কথা এসব। তখন প্রচলিত ছিল ব্রোকেন হোম,” আর আমাদের চেনাশোনার মধ্যে একমাত্র
এডরিয়্যান-ই অমন এক পরিবার থেকে এসেছিল। অস্তিত্বের সংকট নিয়ে ওর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট ছিল কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। এডরিয়্যান বলত ও ওর মা-কে ভালোবাসে আর বাবাকে শ্রদ্ধা করে। গোপনে আমরা তিনজন এডরিয়্যানের ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করতাম এ বিষয়ে এক তত্ত্বও বের করেছিলাম আমরা। সুখী পারিবারিক জীবনের চাবিকাঠি হল কোন পরিবার না থাকা। কিংবা অন্ততঃ পক্ষে এক ছাদের নিচে, একসাথে বসবাস না করা। এই বিশ্লেষণে পৌঁছবার পর থেকে আমরা এডরিয়্যানকে আরো বেশি ঈর্ষা করতে শুরু করেছিলাম।

(চলবে)

প্রকাশিতঃ  http://www.banglamati.net/June-12/novel.php


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন